লিভারের রোগে কি খাবেন আর কি খাবেন না

লিভারের রোগে কি খাবেন আর কি খাবেন না
মানুষজন কারো সাহসিকতা প্রকাশ করার জন্য কথায় কথায় বলে থাকেন অমুকের কতো বড় কলিজা! কিন্তু কলিজা বড় হওয়া মোটেও ভালো কথা নয় এটিও এক প্রকার লিভারের রোগ!  এসব শুনে কি হাসি পাচ্ছে?   তাহলে আপনাকে আগে জানতে হবে লিভারের রোগ গুলো সম্পর্কে
যকৃত বা কলিজা বা লিভার, যেভাবেই বলা হোক না কেন এটি আমাদের দেহের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি যা আমাদের বক্ষপিঞ্জরের নিচের দিকে অবস্থিত। এটি আমাদের খাদ্য পরিপাক, শক্তি সঞ্চয় দেহ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে
বিভিন্ন কারণে লিভারের অসুখ হয়ে থাকে। এর মধ্যে নিম্নোক্ত কারনে বেশি হয়
বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণেঃ লিভারের হেপাটাইটিস , বি এবং সি রোগ হয়ে থাকে
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনঃ মাদকদ্রব্য সেবন, ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ অতিরিক্ত এলকোহল বা মদ্যপানের কারণে হতে পারে ফ্যাটি লিভার এবং লিভার সিরোসিস রোগ
লিভার ক্যান্সারঃ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের আক্রমনে অথবা দীর্ঘ দিন ধরে লিভারের কোন রোগ চিকিৎসাহীন অবস্থায় থাকলে লিভার কান্সার হতে পারে
বংশগত কারনেঃ এছাড়া উইলসন ডিজিজ হেমোক্রোমাটোসিস নামেও লিভারের দুটি রোগ হয়ে থাকে যা প্রধানত বংশগত
লিভার রোগের সাধারণ লক্ষনসমূহঃ  
লিভারের রোগের বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ থাকে। হালকা কিন্তু ঘন ঘন জ্বর, পেটে ব্যথা, ঘন ঘন পেট খারাপ, বেশিরভাগ সময় পেট পা ফুলে যায়, মলমূত্রের রঙ পরিবর্তিত হয় এবং জন্ডিস হয়ে থাকে। জন্ডিস কিন্তু কোন রোগ নয়, এটি লিভারের রোগের লক্ষণমাত্র
জেনে রাখা ভালো লিভারের রোগ গুলি কোন লক্ষণ প্রকাশ না করে অনেকদিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারণ। যার কারনে এর ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি
লিভার রোগে যে ধরণের খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে :
লিভারের রোগের জন্য রোগীকে একটি সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হয়। কারণ লিভারের রোগে কিছু কিছু খাবার খাওয়া সীমিত করতে হয় আবার কিছু কিছু খাবার বেশি পরিমাণে খেতে হয়। লিভার রোগের ডায়েট লিভারকে সুস্থ করে, লিভারের কর্মক্ষমতা ফিরে পেটে সাহায্য করে এবং লিভারের অতিরিক্ত কাজ কমায়
আমাদের প্রতিদিনের খাবারে যে প্রোটিন আমরা গ্রহণ করে থাকি তা আমাদের দেহের কোষ গঠনে কাজ করে। প্রোটিন দেহের ফ্যাট কমায় এবং লিভারের কোষের ক্ষতি রোধ করে। তবে যেসকল রোগীদের লিভার খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় থাকে তাদের দেহে প্রোটিন পরিপাক শোষণ হয়না। যার কারণে দেহে অনেক বর্জ্য উপাদান তৈরি হয় এবং তা ব্রেনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই লিভারের রোগের রোগীদের কিছু বিষয় মাথায় রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে
. দৈনিক আহারে প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ সীমিত করতে হবে তবে একদম বন্ধ করা যাবে না। এতে দেহের ক্ষতিকর উপাদান উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাবে
. খাদ্যে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ কমানোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে
. ডাক্তার ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন মিনারেল সাপ্লিমেন্টস মেডিসিন খেতে হবে যা রোগীর রক্তস্বল্পতা, নার্ভ এর সমস্যা পুষ্টি সম্পর্কিত সমস্যা দূর করবে। লিভারের রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে এই সমস্যা গুলো দেখা যায়
. খাবারে লবণের পরিমাণ একদমই কমিয়ে দিতে হবে। লিভারের রোগে আক্রান্ত রোগীদের খাবারে লবণ তাদের দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়ে থাকে। এটি রোগীদের লিভার ফুলে যাওয়া এবং শরীরে পানি বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী
. রোগীকে একটি ব্যালেন্সড ডায়েট মেনে চলতে হবে। সকল ফুড গ্রুপ থেকে নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। দৈনিক আহারে খাদ্যশস্য, ফল শাকসবজি, মাংস বিভিন্ন সীমের বীচি, ডাল, দুধ ইত্যাদি জাতীয় খাদ্য রাখতে হবে
. আঁশ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। কারণ এটি আমাদের লিভারকে কর্মক্ষম রাখে। ফলমূল, শাকসবজি, অপরিশোধিত খাদ্যশস্য বা হোলগ্রেন খাবার যেমনঢেঁকি ছাটা চাল, লাল আটার রুটি ইত্যাদি রোগীর দেহের খাদ্য আঁশের চাহিদা পূরণ করবে
. পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে। এটি দেহের পানিস্বল্পতা দূর করবে লিভারকে সচল রাখতে সাহায্য করবে
. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য বেশি পরিমাণে খেতে হবে কারণ এগুলো লিভারে ইনফেকশন কমাতে সাহায্য করে
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার সমূহ কি কি তা জানতে দেখুন  অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট  পোস্ট টি
এখন জেনে নিই কি কি খাদ্য লিভারের রোগ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেঃ
. দুধ দুগ্ধজাত খাবার : এটি লিভারকে পরবর্তীকালে আবার ড্যামেজ হওয়া থেকে রক্ষা করে
. বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ: তেলযুক্ত সামুদ্রিক মাছ যেমনস্যামন, সার্ডিন, হেরিং, টুনা, ম্যাকারেল ইত্যাদি মাছ লিভারের রোগে খুবই উপাদেয়। কারণ এতে আছে ওমেগা- ফ্যাটি এসিড যা লিভারের ফ্যাট লেভেল কমায় লিভারের বিভিন্ন ইনফেকশন হ্রাস করতে সাহায্য করে
. সবুজ শাকসবজি: এটি দেহে চর্বির গঠন হ্রাস করে এবং লিভারের রোগ থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। ব্রকলি, পালংশাক, সরিষা শাক ইত্যাদি সবুজ শাকসবজি লিভারে চর্বি জমতে বাঁধা দেয়
. ওটমিল বা হোলগ্রেন খাদ্যশস্য: এটি দেহে শক্তি উৎপন্ন করে, খাদ্য আঁশের চাহিদা মেটায় এবং দেহের অতিরিক্ত ওজন ঠিক রাখতে সাহায্য করে
. আখরোট এবং অনান্য বাদাম: ওমেগা- যুক্ত খাবার এটি, যা লিভারের কাজে সাহায্য করে
. অ্যাভোকাডো : এতে আছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং কিছু উপকারী উপাদান যা লিভার ড্যামেজের গতি কমায় এছাড়া এতে আছে খাদ্য আঁশ যা লিভার রোগে উপাদেয়
. কফি: এটি লিভারের অস্বাভাবিক এনজাইম ক্ষরণ হ্রাস করে লিভার রোগের ঝুঁকি কমায়
. অলিভ অয়েল : লিভার রোগীদের খাবার অলিভ অয়েলে রান্না করা উচিত। কারণ ওমেগা- ফ্যাটি এসিড আছে এবং এটি লিভারের এনজাইম নিয়ন্ত্রণে কাজ করে
. রসুন : এটি ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীদের দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করে
১০. গ্রিন টি : এটি লিভারের ফ্যাট স্টোরেজ হ্রাস করে লিভারকে কর্মক্ষম করে। এছাড়া দেহের কোলেস্টেরল কমায়
লিভারের রোগে যেসব খাদ্য পরিহার করতে হবেঃ  
. এলকোহল লিভারের রোগ সৃষ্টির প্রধান কারণ। যেকোন ধরণের মাদকদ্রব্য সেবন মদ্যপান পুরোপুরি বাদ দিতে হবে
. অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার যেমনকোমল পানীয়, ক্যান্ডি, বিস্কুট, সোডা, ফ্রুট জুস ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে
. যেকোন ধরনের তেলেভাজা খাবার পরিহার করতে হবে
. খাবারে বেশি লবণ বাদ দিতে হবে কারণ এটি দেহে পানি জমার জন্য দায়ী যা লিভারের জন্য ক্ষতিকর
. অতিরিক্ত পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য মানে সাদা আটা, ময়দা, চাল বাদ দিতে হবে। এগুলো দেহের ব্লাড সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়
. রেড মিট বা গরু, খাসির মাংসে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা লিভারের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর, তাই এগুলো খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে
এভাবে সঠিক উপায়ে খাদ্যাভ্যাস মেনে চললে লিভারের রোগ থেকে খুব সহজেই নিরাময় সম্ভব। বিভিন্ন লিভারের রোগের রোগী ছাড়াও সাধারণ মানুষ এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে নিলে লিভারের রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে রেহাই পাওয়া যাবে
লেখক-
আনিকা জাহিন ত্রনি, খাদ্য পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ 

No comments

Powered by Blogger.